23 Oct 2024, 07:29 am

সোশ্যাল নেটওয়ার্কের ব্যাপারে পাশ্চাত্যের দ্বিমুখী নীতিতে টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : ফ্রান্সে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পাভেল দুরভকে গ্রেপ্তারের সাথে সাথে ব্যক্তি ও সমাজিক স্বাধীনতার দাবিদার পশ্চিমাদের প্রকৃত চেহারা আবারো সবার সামনে প্রকাশিত হলো।

ফরাসি সরকার টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতাকে মাদক ক্রয়-বিক্রয়, শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়ন এবং সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের পরিবেশ তৈরির মতো গুরুতর অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। পার্সটুডে-এর মতে, এই গ্রেপ্তারের ঘটনা দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় তুলেছে। অনেকে ফরাসি সরকারের পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে এবং ইউরোপের বিশেষ করে ফ্রান্সের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় গ্রেফতারের প্রয়োজন ছিল মনে করছে। কিন্তু অনেকে আবার এই গ্রেপ্তারকে ফ্রান্সের ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান হিসাবে দেখছে। তাদের মতে এ পদক্ষেপ প্যারিসসহ পাশ্চাত্য বিশ্ব ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার যে স্লোগান দেয় তার লঙ্ঘন।

টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতাকে গ্রেফতারের ঘটনার প্রভাব ও নানা দিক এবং পাশ্চাত্যে ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রকৃত অবস্থা নিয়ে পার্সটুডেকে দেয়া সাক্ষাতে কথা বলেছেন ইরানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষক ডক্টর রহমান কাহরেমন পুর।

এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষক মনে করেন,  মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এমন একটি তাত্ত্বিক ও মৌলিক বিষয় যা নিয়ে বিতর্ক সবসময়ই ছিল। তিনি বলেন: বাস্তবতা হলো স্বাধীনতার বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলো সবসময় দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করেছে। এবার টেলিগ্রামের সিইওকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে এই দ্বিমুখী আচরণের আরেকটি দিক প্রকাশ পেয়েছে।

একচেটিয়া ও অনিয়ন্ত্রিত হুমকি তৈরিতে সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক : পাশ্চাত্য বিশেষ করে ফ্রান্স যে কারণে বর্তমান সময়ে টেলিগ্রামের মালিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সে সম্পর্কে ডঃ কাহরেমন পুর বলেছেন: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগমণের একইসাথে টেলিগ্রামসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কগুলোর সংবেদনশীলতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ব্যবহারকারীদের আরো বেশি তথ্য সংগ্রহের সুযোগ এনে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কগুলোর মালিকদের লক্ষ্য হল আরও বেশি ব্যবহারকারীকে আকৃষ্ট করা যাতে তারা আরও বিজ্ঞাপন পেতে পারে এবং তাদের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী কোরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একচেটিয়া আধিপত্য বা প্রভাব গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু তাদের এ টার্গেট পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রনায়কদের ইচ্ছার বিরোধী।

আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে টেলিগ্রামসহ ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কগুলো ব্যবহারকারীদের ব্যাপক ও অনিয়ন্ত্রিত সুযোগ সুবিধা, যার কারণে পশ্চিমা সরকারগুলোর মধ্যে এসবের ব্যবহারকারীদের ব্যাপারে সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা, ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কগুলো ব্যবহারকারীরা এখন কোনো দুশ্চিন্তা ছাড়াই বিশ্বব্যাপী তাদের তথ্য প্রকাশ করতে পারছে। এ বিষয়টি অনেক সরকারের জন্য একটি রেড লাইন। প্রকৃতপক্ষে, এই প্ল্যাটফর্মগুলোর কারণে, সরকারগুলো আর সহজে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে পারছে না এবং বহু বিষয়ের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না।

ইরানের এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যাপারে পশ্চিমা বিশেষ করে ফ্রান্সের দ্বৈত আচরণের উদাহরণ সম্পর্কে বলেছেন, ফ্রান্সে বোরকা বা হিজাব মহিলাদের জন্য নিষিদ্ধ, অথচ স্বাধীনতার মৌলিক নীতিতে শালীন পোশাক পরার অধিকার মানুষের রয়েছে। তাই এই নিষেধাজ্ঞা কি স্বাধীনতার লঙ্ঘন নয়?

আরেকটি উদাহরণ হিসাবে, মুসলিম বিদ্বেষী ফরাসি ব্যঙ্গাত্মক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘চার্লি হেবদো’র কথা উল্লেখ করা যায়। ফ্রান্সে বিপুল সংখ্যক মুসলমান বসবাস করলেও বহুবার মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘চার্লি হেবদো’। কিন্তু তখন এই ম্যাগাজিনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বরং বাক স্বাধীনতার কথা বলে তাদেরকে ন্যায্যতা দিয়েছে ফরাসি সরকার। প্রকৃতপক্ষে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর এই দ্বৈত আচরণগুলো সবসময়ই লক্ষ্য করা গেছে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পশ্চিমা সরকারগুলোর এই দ্বিমুখী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে  কাহরামানপুর বলেছেন,

পশ্চিমা দেশগুলো একদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে জনকল্যাণকর বলছে। আবার, যাকিছু সরকারের জন্য ক্ষতিকর সেগুলোর বিরুদ্ধেও তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে। তাদের দাবি এ ধরণের পদক্ষেপ গণতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কেননা ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কগুলোতে জনকল্যাণও রয়েছে।

এই নীতির আলোকে ক্ষতিকর দেখিয়ে টেলিগ্রামের সিইওকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু এই পদক্ষেপের বিরোধিতাকারীদের বক্তব্য হচ্ছে, আমরা একটি মুক্তবিশ্বে বাস করি এবং মানুষের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করা হয়,তাই এক্ষেত্রে যে কোনও সীমাবদ্ধতা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করবে। তারা ফ্রান্স সরকারের এ পদক্ষেপকে ব্যক্তি স্বাধীনতার লঙ্ঘন বলে মনে করেন।

পশ্চিমা দেশগুলো তাদের স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্বাধীনতার সীমানা ব্যাখ্যা করে : ডক্টর কাহরেমন পুর বলেছেন, “ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা তাদের নীতির ন্যায্যতা এবং তাদের নিজস্ব স্বার্থ সুরক্ষার জন্য উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবিধাগুলো নেয়ার চেষ্টা করে।যেমনটি ২০১৬ সালে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এর ব্যবহারকারীদের কোনো অনুমতি ছাড়াই তাদের তথ্যের কিছু অংশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচার কাজে সরবরাহ করেছিল যা কিনা ট্রাম্পের বিজয়ে ভূমিকা রেখেছিল। আর এখন সন্ত্রাস,মাদকের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে টেলিগ্রামের  অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে, এই নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা পাভেল দুরভকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

স্বাধীনতা একটি আদর্শ : ইরানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক এই গবেষক ব্যক্তি ও সামাজিক স্বাধীনতায় ক্ষমতাসীনদের ভূমিকা সম্পর্কে বলেছেন,প্রকৃতপক্ষে, মতপ্রকাশের মাধ্যমগুলো এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যা সবময়ই ক্ষমতাসীনদের অনুগত হয়ে চলে। এ ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে দখলদার ইসরাইলের নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপারে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর নীতির কথা উল্লেখ করা যায়।  এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে,পশ্চিমা মিডিয়াগুলো বছরের পর বছর ধরে ইসরাইলি নৃশংসতার ব্যাপারে নীরব রয়েছে এবং ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার বিষয়টি খুবই তাদের রিপোর্ট ও প্রতিবেদনে উঠে আসে।

অন্য কথায়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী দেশগুলো সবসময় মিডিয়ায় তাদের একচ্ছত্র প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টা করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংকট ও নানা ইস্যুতে বিবিসি ও সিএনএন-এর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হয়ে আছে। যেমন, ফিলিস্তিনে ইসরাইলি জবরদখল, মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এমনকি কোরআন পোড়ানো, কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর নির্যাতন প্রভৃতি তুলে ধরার ক্ষেত্রে এইসব গণমাধ্যমের নির্লিপ্ততার কথা উল্লেখ করা যায়।

ডক্টর কাহরেমন পুর বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো গণমাধ্যমের সাহায্যে ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে দেশটির সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটে তারা ইরানকে স্বাধীনতা লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করে অপপ্রচার চালায়। অথচ ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যাপারে  তারা  নিজেরাই দ্বিমুখী আচরণ করছে।  যেখানে তাদের স্বার্থ আছে সেখানে প্রতিক্রিয়া দেখায় আবার যেখানে স্বার্থ নেই সেখানে নীরব থাকে। প্রকৃতপক্ষে, ইরান পাশ্চাত্যের আধিপত্যকামী নীতির  বিরোধিতা করার কারণে ওই দেশগুলো সবসময় ইরানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করে আসছে। এরই অংশ হিসাবে তারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাধীনতা লংঘন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপের অভিযোগ তুলেছে। অথচ তারা নিজেরাই সামাজিক নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

ডক্টর কাহরেমন পুর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক সংকটে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর মিডিয়া সবসময় সরকারগুলোর রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে। তারা স্বাধীনতার কথা বললেও বাস্তবে পশ্চিমা সরকারের নীতি আদর্শন বাস্তবায় করে চলেছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 3884
  • Total Visits: 1184518
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1639

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ বুধবার, ২৩শে অক্টোবর, ২০২৪ ইং
  • ৮ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ১৯শে রবিউস-সানি, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, সকাল ৭:২৯

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
21222324252627
28293031   
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018